দেবদাসী প্রথা কী আজও ভারতীয় সমাজে আছে ?

দেবদাসী প্রথা : ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে বর্বর প্রথা গুলির সঙ্গে ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ধর্মের দোহাই দিয়েই জীবন্ত নারীকে পুড়িয়ে মারা হতো মৃত স্বামীর সঙ্গে, ধর্মের দোহাই দিয়েই পুরুষ অধিকার পেত একসঙ্গে একাধিক বিয়ে করার।

দেবদাসী প্রথা

ধর্মের দোহাই দিয়েই নিষ্ফলা জমি রক্ত পেত শিশুকন্যার। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন এই সমস্ত অযুক্তির ধর্মপালনের দায় প্রধানত নারীদের। পুরাকাল হোক বা বর্তমানে পুরুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ধর্ম।

ব্যাপারটা কি সম্পূর্ণ কাকতালীয়? নাকি এর পেছনে রয়ে গেছে গূঢ় কোন পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি? সেই আলোচনা পরে হবে। আমাদের আলোচ্য এই ধরনের অযৌক্তিক প্রথা গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি প্রথা হল-দেবদাসী প্রথা। মূলত ভারতেই এই প্রথার চল বেশী ছিল। ইতিহাস বলে মেসোপটেমিয়া সভ্যতাও সাক্ষী থেকেছে এই কুপ্রথার এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে শুরু করে বহু প্রাচীন পুঁথিতে দেবদাসী প্রথার বর্ননা আছে।

কী এই দেবদাসী প্রথা?

তৎকালীন ভারতের সমাজ ব্যবস্থাকে অনেকটা পরিচালনা করত  মন্দির ও পুরোহিতেরা। রাজা বা জমিদাররাও পুরোহিতদের সমীহ করে চলতেন। এই প্রথায় দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য

অতি অল্প বয়সেই একটি মেয়েকে দেব মূর্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকে সেই মেয়ে মন্দিরের অধীনস্থ আবাসেই থাকতো। মন্দির পরিস্কার রাখা , পূজোর যোগাড় ইত্যাদি কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে পুরাকালে এইসব বালিকা দেবদাসীদের নৃত্য,গীত ইত্যাদি কলায় শিক্ষিত করা হতো। তারা দেবতা‌ তথা পুরোহিতদের সামনে নৃত্যগীত পরিবেশন করত।

তাদের জীবনে অন্য পুরুষের স্থান ছিল না, অন্য কোন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার ও তাদের ছিল না। কিন্তু দেবতার আছিলায় তারা প্রায় সবসময়ই পুরোহিতদের বা স্হানীয় ক্ষমতাবান মানুষের ভোগ্য বস্তু হয়ে উঠতেন।

ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাদের গ্রহণ করতে হতো পতিতাবৃত্তি। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যও অনেক দেবদাসী পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যেত ধর্মীয় লালসার দাবানলে। সমাজ এই বর্বরতার নাম রেখেছিল – পবিত্র পতিতাবৃত্তি এবং অত্যাচারিত নারীদের যন্ত্রনার  ব্যাপারে বহুকাল চোখে কুন্তীর মতো কাপড় বেঁধে অন্ধ হয়ে বসেছিল। ১৯৯২ সাল থেকে দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়।

তবে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই মূলত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যগুলি আইন করে এই প্রথা বন্ধ করার ‌নির্দেশ চালু করে (মাদ্রাজ দেবদাসী আইন ১৯৪৭ , বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, কর্নাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২ ইত্যাদি)। দেবদাসী উচ্ছেদের দাবীতে যেসকল ভারতীয়দের নাম উল্লেখ করা যায় তাদের মধ্যে পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, তামিলনাড়ুর ডাক্তার মুথ্থুলক্ষী রেড্ডি প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। গান্ধীজিও এই প্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।

এরপর কি সম্পূর্ণভাবে সভ্যতার পাতা থেকে মুছে গেল এই কুপ্রথা ?

উত্তর খুঁজতে গেলে অবাক হতে হয়। কারণ একবিংশ শতাব্দীর উন্নতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই প্রথা আজও দাপটের সঙ্গে বিরাজ করছে ভারতের কিছু স্হানে। মাঝে মাঝে খবরের পাতা কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় উঠে আসে এই খবর। সরকার কর্তৃক বেআইনি ঘোষণা হওয়ার বহু বছর পরও স্বমহিমায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিরাজমান দেবদাসী প্রথা। এদের মধ্যে তামিলনাড়ু , কর্ণাটক,অন্ধ্রপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্য গুলির নাম উঠে এসেছে। বিশেষত কর্নাটকে এখনও বেআইনি ভাবে দেবদাসী প্রথা চালু আছে। অন্ধ্রপ্রদেশে বল প্রয়োগ করে বালিকাকে ধর্মের অজুহাতে নগ্ন করার খবর উঠে আসে। শুধু তাই নয়, পূণ্যলাভের লোভে কর্নাটকের এক দম্পতি জোর করে নিজের মেয়েকে দেবদাসী বানানোর খবরও পড়তে হয় একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে।

তালিবানের কবলে আফগানিস্তান

অগ্নিবীরদের চার বছর পর ভবিষ্যৎ কি? বিস্তারিত জানুন

দেবদাসী প্রথা এর শেষ কোথায়?

তবে আশার কথা মানবাধিকার কমিশন , বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হস্তক্ষেপে তলানিতে এসে ঠেকেছে এই সামাজিক শোষনের প্রথা। তবু প্রশাসনিক অবহেলা, নির্মম দারিদ্র্য ও বহুল ধর্মান্ধতার  প্রভাবে ভারতের মতো প্রগতিশীল দেশকেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে দেবদাসী প্রথার মত কলঙ্ক। সমাজবিদদের মতে একমাত্র সুশিক্ষা ও প্রশাসনিক কঠোরতাই পারে ভারতের বুক থেকে এই কুপ্রথার কলঙ্ক মুছে ‌দিতে।

W- Nita Dey

নতুন খবর এবং টেকনিকাল খেলাধুলা জ্ঞান মূলক তথ্য জানতে হলে আমাদের নোটিফিকেশন বেলটি Allow করতে ভুলবেন না এবং আমাদের সাথে জুড়ে থাকবেন।

Leave a Comment