সময়টা একবিংশ শতাব্দী এবং ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ। শিক্ষিতের হার ৭৭.৭ শতাংশ। তবুও দেশের আনাচে-কানাচে ঘাপটি মেরে বসে আছে কুশিক্ষার বারুদ। একটা ছোট আগুনের ফুলকি পেলেই জ্বলে উঠে পুড়িয়ে দেয় সমাজ নামক ব্যবস্থার সুরক্ষা , মানবতাবোধ ও বিবেচনা শক্তি। অযৌক্তিকতা বিপদসীমা ছাড়ালে তা কুসংস্কার হয় টেনে আনে মানুষের অভ্যন্তরীণ পাশবিকতাকে। ভারতীয়দের মধ্যে কুসংস্কার কতটা বদ্ধমূল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ডাইনি সন্দেহে মানুষকে গ্রামছাড়া করা , পিটিয়ে মারা, পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনা।
ডাইনি কি?
কথকতা অনুযায়ী ‘ডাক’ হলো এক ধরনের পিশাচ। এই ডাকের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ‘ডাকিনী’ এবং এই ডাকিনী থেকে ডাইনি নামটির উৎপত্তি। তবে এসব যে ছেলেভুলানো কল্পনা বা কুশিক্ষার বেশী কিছু নয় , একথা শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই বোঝার কথা।
কিভাবে একজন সাধারন মানুষ হঠাৎ সকলের চোখে ডাইনি হয়ে ওঠেন?
ঘটনা গুলীর বিশ্লেষণ একটি উদাহরণ দিয়ে করা যাক। ঝাড়খণ্ডের একটি আশংকাজনক ভাবে পিছিয়ে পরা গ্রাম। নাম – কাঞ্জিয়া মারাইটোলি। সেখানকার মানুষজন পরিষ্কার পানীয় জলের সুবিধা পান না, প্রাতঃকৃত্য সারেন খোলা স্থানেই। এর উপরে আছে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। গ্রামের সিংহভাগ মানুষ মহুয়ার নেশায় আসক্ত। এখন এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও জীবন যাপনের প্রভাবে মানুষজন পাকস্থলীর অসুখ ও অন্যান্য অসুখে যে আক্রান্ত হবেন এ কথাটা উল্লেখ না করলেও বোঝা যায়। এইসকল অসুস্থতার কারণ হিসেবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ কিছুসংখ্যক মহিলাকে দায়ী করেন। গ্রামের ওঝারা এ ব্যাপারে অধিনায়কত্ব পালন করে থাকেন। সে আঙ্গুল তুলে কোন নারীর দিকে তাক করলেই গ্রামের মানুষজন দলবেঁধে বিভিন্ন পাশবিক উপায়ে তাকে মৃত্যু উপহার দিয়ে থাকেন। এছাড়া গ্রামছাড়া করা , এক ঘরে করে রাখা বা উলঙ্গ করে গ্রাম ঘোরানো – এগুলোতো ন্যুনতম শাস্তি।
তবে একজন নির্দিষ্ট নারীকে কেন ডাইনির তকমা দেওয়া হচ্ছে তার পেছনে বেশিরভাগ সময় সমাজের গূঢ় স্বার্থ কাজ করে। এ প্রসঙ্গে আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন – পিছিয়ে পড়া অশিক্ষিত স্থানগুলিতে কোন নারীর স্বামী মারা গেলে বলা হয় সে তার স্বামীকে ‘খেয়েছে’ এবং বিশ্বাস করা হয় এভাবেই নাকি একজন নারী ডাইনি হয়ে ওঠেন। এরপরেই নাকি সে ক্ষতিসাধন করতে শুরু করে গ্রাম, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের। তবে ঘটনার গভীরে ঢুকলে দেখা যাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসহায়, আত্মীয়হীন নারীর সম্পত্তির হস্তগত করার জন্য বা অন্য কোন ব্যক্তি স্বার্থ বা আক্রোশের কবলে পড়ে ডাইনি অপবাদে বলি হতে হয় নিরীহ নারীদের।তবে কিছু ক্ষেত্রে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদেরও ডাইনি অপবাদে অত্যাচার বা হত্যার দৃষ্টান্তও কম না। সবচেয়ে বেশি আশঙ্কাজনক তথ্য হলো বহু শিক্ষিত মানুষ বা কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের দল নির্বিবাদে মেনে নেয়নি জাতীয় কুসংস্কারকে। উন্মত্ত জনতার দলে তারাও যোগ দেয় অসহায় নারীটিকে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মারতে। অসুস্থ মস্তিষ্ক প্রোথিত নারীবিদ্বেষ (misogyny) ছাড়া কিভাবেই বা এই পাশবিকতাকে ব্যাখ্যা করা যায়!
আরও পরুনঃ দেবদাসী প্রথা কী আজও ভারতীয় সমাজে আছে ?
আরও পরুনঃ তালিবানের কবলে আফগানিস্তান
ডাইনি অপবাদে খুনের সংক্রান্ত আইন :
ডাইনি অপবাদে খুন করার অভিযোগে ভারতীয় সংবিধানের ৩০২ ধারায় বিচার করার কথা বলা আছে। ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করায় কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে প্ররোচনার দায়ে সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা ও 1 থেকে 5 লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। এক্ষেত্রে তদন্তে গাফিলতি দেখা গেলে তদন্তকারীর বিরুদ্ধে জরিমানা ধার্য আছে ১০,০০০টাকা। এই আইনটির নাম হল – prevention of and protection from witch hunting bill, 2015.
কতটা কার্যকরী ডাইনি অপবাদ প্রতিরোধ আইন?
২০১৫ সালে এই আইন গৃহীত এবং স্বীকৃত হবার পরেও ডাইনি-হত্যা স্বমহিমায় চলছে। কুসংস্কার এতই ভয়ানক, যে প্রতিদিন খবরের কাগজে টেলিভিশনের পর্দায় এসব অন্যায় প্রত্যক্ষ করলেও প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ অসহায় অনুভব করেছেন। এমন গ্রামের সংখ্যা বিরল নয় যেখানে গ্রামবাসীরা এক্ষেত্রে পুলিশকে প্রবেশ বা হস্তক্ষেপের সুযোগই দেয়নি। আবার তদন্ত চলাকালীন পুলিশকে বিভ্রান্ত করতেও সমস্ত উপায় অবলম্বন করে বসে আছে।
মানুষের চেতনা থেকে কি কখনো মুছে যাবে ‘ডাইনি’ নামের কুসংস্কার?
একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা গ্রাম যারা ডাইনি অপবাদে প্রায়সই হত্যা করে থাকে সেই গ্রামের নারীদের, তাদের মধ্যে যে সুশিক্ষা, মূল্যবোধ ও বিজ্ঞানচেতনার কতটা ঘাটতি সে কথা নতুন করে বলে দিতে হয় না। তাই বর্বরতার রুখতে সবার আগে এদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করাই একমাত্র পথ। এছাড়া প্রশাসনের আরো কড়া হাতে ঘটনার বিশ্লেষণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ বিশেষ জরুরী। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন নয় তা কার্যকরী করার দিকটি খতিয়ে দেখলে ,আশা করা যায় একদিন থেমে যাবে কুসংস্কারের হাড়িকাঠে একের পর এক নারীর ডাইনি অপবাদে বলি যাবার বীভৎসতা।
W-Nita Dey
নতুন খবর এবং টেকনিকাল খেলাধুলা জ্ঞান মূলক তথ্য জানতে হলে আমাদের নোটিফিকেশন বেলটি Allow করতে ভুলবেন না এবং আমাদের সাথে জুড়ে থাকবেন।